বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ: মাইকেল মধুসূদন দত্ত

কবি পরিচিতি:-
বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য প্রতিভাধর কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাংলা সাহিত্যকে সামগ্রিকভাবে ক্লাসিক্যাল পর্যায়ে উত্তীর্ণ করার ক্ষেত্রে মাইকেলের ভূমিকাই প্রথম। যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রাম মধুসূদনের জন্মস্থান হলেও তাঁর পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস ছিল খুলনায়। মাইকেলের পিতার নাম রাজনারায়ণ দত্ত, মাতা-জাহ্নবী দেবী। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন ভারতীয় সাহিত্যে আধুনিকতা এবং আধুনিক যুগের প্রবর্তক আধুনিক বাংলা সাহিত্য যে গৌরবে আজ বিশ্বসাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত, মাইকেলই তার সূচনা করেছিলেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভাবসম্পদ ও আঙ্গিককে বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারে গ্রহণের পথ তিনিই দেখিয়েছেন সর্বপ্রথম।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক, প্রহসন, মহাকাব্য তাঁরই অবদান। বাংলা ‘সনেট’- এর ¯্রষ্টাও তিনিই। তবে বাংলা কাব্যকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’ই মাইকেলের সবছেয়ে’ বড় অবদান। অমিত্রাক্ষর ছন্দে “তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য” রচনা করেই মাইকেল বাংলা ছন্দের মুক্তির পথকে করলেন ত্বরান্বিত। সাহিত্যের ক্ষেত্রে উচ্চ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেও ব্যক্তিজীবনে মধুসূদনের শান্তি ও সুখ ভোগ ছিল না। উচ্চাশা ও বিশৃঙ্খল জীবন যাপনই মূলত তার সর্বনাশের জন্য দায়ী। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে মাইকেল উপাধি গ্রহণের মাধ্যমে মধুসূদন খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং এ সময়ে ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তাঁর তীব্র আকর্ষণ জন্মে, যা পরবর্তীতে উন্মাদনায় পরিণত হয়। মাইকেল ১৩/১৪টি ভাষা আয়ত্ত করেন- বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, ফরাসি, সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু, ল্যাটিন, গ্রীক, হিব্র“, জার্মান ও ইতালিয়ান ইত্যাদি।

অমিতব্যয়ী জীবন যাপনের ফলে জীবনের শেষ পর্যায়ে মাইকেলকে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। বাঙলা সাহিত্যে এমন ভাগ্য-বিড়ম্বিত কবি বিরল।

কবি সম্পর্কিত তথ্য:-

  1. জন্ম- ২৫ জানুয়ারি, ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দ।
  2. জন্মস্থান- যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে।
  3. মৃত্যু- ২৯ জুন, ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ।
  4. প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ- Captive Lady (১৮৪৯)
  5. প্রথম নাটক- শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯)
  6. প্রথম কাব্য- তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য(১৮৬০)
  7. মহাকাব্য- মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১)
  8. শ্রেষ্ঠদান- অমিত্রাক্ষর ছন্দ ও বাংলা সনেট
  9. ছদ্মনাম-টিমোথি পেনপয়েম, A native
  10. বাংলা আধুনিক কবিতার জনক।
  11. বাংলা সনেটের জনক।
  12. বাংলা প্রথম মহাকাব্যের জনক।
  13. অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক।
  14. বাংলা প্রথম প্রহসনের জনক।

মধুসূদনের সাহিত্যকর্ম:-
মহাকাব্য: মেঘনাদবধ কাব্য।
কাব্য: তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, বীরাঙ্গনা, ব্রজাঙ্গনা, চতুর্দশপদী কবিতাবলী।
নাটক: শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী, কৃষ্ণকুমারী, মায়াকানন (অসম্পূর্ণ)
প্রহসন: একেই কি বলে সভ্যতা?, বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ।

পাঠ পরিচিতি:-
“বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ” কাব্যাংশটুকু মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ Ñকাব্যে’র ‘বধো’ (বধ) নামক ষষ্ঠ সর্গ থেকে সংকলিত হয়েছে। সর্বমোট নয়টি সর্গে বিন্যস্ত ‘মেঘনাদবধÑকাব্যে’র ষষ্ঠ সর্গে লক্ষ্মণের হাতে অন্যায় যুদ্ধে মৃত্যু ঘটে অসমসাহসী বীর মেঘনাদের।
উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাল্মীকি-রামায়ণকে নবমূল্য দান করেছেন এ কাব্যে। মানবকেন্দ্রিকতাই রেনেসাঁস বা নবজাগরণের সারকথা।

“বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ” কবিতাটি ১৪ মাত্রার অমিল প্রবাহমান, যদিও স্বাধীন অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। প্রথম পঙ্ক্তির সঙ্গে দ্বিতীয় পঙ্ক্তির চরণান্তেমিলহীনতার কারণে এ ছন্দ ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’ নামে পরিচিত। এ কাব্যাংশের প্রতিটি পঙ্ক্তি ১৪ মাত্রায় এবং ৮+৬ মাত্রার দুটি পর্বে বিন্যস্ত। লক্ষ্য করার বিষয় যে, এখানে দুই পঙ্ক্তির চরণান্তিক মিলই কেবল পরিহার করা হয়নি, বিরামচিহ্নের স্বাধীন ব্যবহারও হয়েছে বিষয় বা বক্তব্যের অর্থের অনুষঙ্গে। এ কারণে ভাবপ্রকাশের প্রবাহমানতাও কাব্যাংশটির ছন্দের বিশেষ লক্ষণ হিসেবে বিবেচ্য।

তথ্যকণিকা:-
০১. ‘বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ’ কাব্যাংশটির উৎস হল ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ ।
০২. নবজাগরণের সারকথা হল মানবকেন্দ্রিক।
০৩. “বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ’ যে ছন্দে রচিত অক্ষরবৃত্ত (অমিল প্রবহমান) ।
০৪. বিভীষণ হল রাবণের কনিষ্ঠ সহোদর ।
০৫. মেঘনাদবধ কাব্যের কাহিনি যে মহাকাব্য হতে গৃহীত হয়েছে রামায়ণ।
০৬. ‘অরিন্দম’ বলতে বোঝানো হয়েছে মেঘনাদকে।
০৭. ‘হে পিতৃব্য’ এখানে পিতৃব্য হল বিভীষণ।

০৮. ‘নহি দোষী আমি’-এখানে ‘আমি’ হল বিভীষণ।
০৯. সৌমিত্রি হল লক্ষ্মণ ।
১০. মহারথী প্রথা হল শ্রেষ্ঠ বীরদের আচরণ প্রথা ।
১১. নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগার অবস্থিত রক্ষপুরীতে।
১২. হে রাক্ষস রামানুজ দ্বারা বোঝানো হয়েছে বিভীষণকে।
১৩. জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি এ সকলে জলাঞ্জলি দিল – বিভীষণ ।
১৪. পরদোষে মজিতে চায় না বিভীষণ।
১৫. নিকষা হল রাবণের মা।
১৬. রাঘবদাস হল বিভীষণ।
১৭. বিভীষণ যার বিপক্ষে কাজ করতে অপারগ রামের বিপক্ষে ।
১৮. অস্ত্রাগারে যেতে চায় মেঘনাদ ।
১৯. কুম্ভকর্ণ হল রাবণের মধ্যম সহোদর ।
২০. লক্ষ্মণ প্রবেশ করল লঙ্কাপুরীতে ।

২১. মেঘনাদ যার ভ্রাতুষ্পুত্র বিভীষণের
২২. মেঘনাদ যাকে চণ্ডাল বলেছে লক্ষ্মণকে ।
২৩. অস্ত্রাগারে যেতে মেঘনাদকে বাধা দিয়েছিল বিভীষণ।
২৪. মেঘনাদের মৃত্যুর মঞ্চ তৈরি করেছিল বিভীষণ।
২৫. মেঘনাদ অধম বলেছে  রামকে।
২৬. মেঘনাদের পিতার নাম হল রাবণ।
২৭. মেঘনাদ তিরস্কার করেছে বিভীষণকে ।
২৮. শাস্ত্র মতে যে ধরণের স্বজন শ্রেয় গুণবান শত্র“ অপেক্ষা গুণহীন স্বজন ।
২৯. ইন্দ্র বা বাসব জয় করেছে ইন্দ্রজিৎ বা মেঘনাদ।
৩০. রথচালনার মাধ্যমে যে যুদ্ধ করে তাকে রথী যুদ্ধ বলে।
৩১. মেঘনাদ নিহত হয় নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ।
৩২. লক্ষ্মণ কার আনুকূল্যে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রবেশ করে বিভীষণের।
৩৩. মেঘনাদকে হত্যা করে লক্ষ্মণ।
৩৪. রাবণের রাজ্যের নাম লঙ্কা।
৩৫. তাত শব্দটি কবিতায় ৫ বার ব্যবহৃত হয়েছে।
৩৬. নিরস্ত্রকে যুদ্ধে আহবান জানিয়েছেন লক্ষ্মণ।
৩৭. লক্ষ্মণকে নির্দেশ করে ব্যবহৃত হয়েছে সৌমিত্রি ও রামানুজ।
৩৮. পিতৃব্যের উক্তি শুনি মরতে ইচ্ছে হচ্ছিল মেঘনাদের।
৩৯. কুম্ভকর্ণ ও বীরবাহুর মৃত্যুর পর মেঘনাদ সেনাপতির পদ লাভ করেন।
৪০. মধুসূদনের সাহিত্যের প্রধান বিষয় দেশপ্রেম, স্বাধীনতার চেতনা এবং নারী জাগরণ।
৪১. মেঘনাদ চাচাকে সম্বোধন করেছেন রক্ষোরথী, রক্ষোমণি, মহারথী, রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, রক্ষোবর, বীরকেশরী, রাক্ষস রামানুজ।
৪২. মেঘনাদকে উদ্দেশ্য করে ব্যবহৃত শব্দ অরিন্দম, বাসববিজয়ী, ধীমান, রাবণি, রাবণআত্মজ, বাসবত্রাস, বীরেন্দ্র বলী।

নিজের সুবিধামত পড়ার জন্য টাইমলাইনে শেয়ার করে রাখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thirteen + 3 =